অর্থনীতি

সরকারি দামকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাল চামড়া সিন্ডিকেট

এবারেও সরকারি দরকে পাত্তা দিল না চামড়া সিন্ডিকেট। চামড়া সংগ্রহকারীরা কোরবানির পশুর চামড়া কেনার পর আড়তদার ও ট্যানারির মালিকদের কাছে বিক্রি করতে গিয়েই বিপাকে পড়েন। অনেকে কেনা দর দিতেও রাজি হননি। বিক্রি করতে না পেরে অনেকে মনের কষ্টে চামড়া ফেলে দিয়েছেন। অনেকে মাটিচাপা দিয়েছেন।

রাজধানীসহ সারা দেশ থেকে খবরের কাগজের নিজস্ব প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরে কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রির এ চিত্র পাওয়া যায়।

জানা যায়, প্রতিবছরের মতো এবারও পাড়া-মহল্লা ঘুরে এতিমখানা, মাদ্রাসার প্রতিনিধিরা কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহ করেছেন। এদের পাশাপাশি কিছু মৌসুমি ও স্থায়ী চামড়া সংগ্রহকারীও কোরবানির পশুর চামড়া কিনেছেন। চামড়া সংগ্রহকারীদের অনেকে নিয়মমতো লবণ মাখাতে পারেননি বলেও অভিযোগ পাওয়া গিয়েছে। এবারে গরম ছিল। সব মিলিয়ে দুপুরের পর থেকে চামড়ার মান কমতে থাকে। গন্ধ ছড়াতে থাকে। চামড়া সংগ্রহকারীরা বিভিন্ন আড়তে ঘুরে এবং ট্যানারির মালিকদের কাছে চামড়া বিক্রির জন্য যোগাযোগ করতে থাকেন। পরিস্থিতি এমন হয় যে, কেনা দরও অনেক ট্যানারির মালিক, আড়তদার দিতে চান না।

অর্থনীতির বিশ্লেষক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মো. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রি করে যা পাওয়া যায় এতিমদের পিছনেই খরচ করা হয়। প্রতিবছর কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে বড় ধরনের সিন্ডিকেট মাঠে থাকে। তারা একজোট হয়ে কম দামে কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রিতে বাধ্য করে। এটা পরোক্ষভাবে এতিমদের ঠকানো।

তিনি আরও বলেন, চামড়া সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় কোরবানির পশুর চামড়া ‌‘সময় নিয়ে’ দরদাম করে বিক্রি করার সুযোগ থাকে না। সরকার বিসিক শিল্পনগরীতে চামড়া সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারে। এতে সিন্ডিকেটের কবল থেকে কোরবানির পশুর চামড়া মুক্তি পাবে।

আরেক অর্থনীতিবিদ বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন খবরের কাগজকে বলেন, ‘ঈদের মৌসুমে অনেক চামড়া একসঙ্গে পাওয়া যায়। সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকলে ধীরে ধীরে দরদাম করে বিক্রি করার সুযোগ পেত। এতে ভালো দাম পেত। চামড়া সিন্ডিকেট প্রতিবছরই এ কাজ করে চামড়া খাতের চরম ক্ষতি করছে।

ট্যানারির মালিকরা দাবি করেছেন, ডলারসংকটের কারণে অনেক দিন থেকেই চামড়ার ব্যবসা ভালো যাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে কোরবানির পশুর চামড়া কিনলে লোকসান হবে।

গতকাল বেড়িবাঁধ হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি মোড় থানা রোডসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে খবরের কাগজ। কোরবানির চামড়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের জামিয়া রহমানিয়া কওমি মাদ্রাসার মাওলানা মিজানুর রহমান কাশেমী বলেন, ‘বহু ট্যানারির সঙ্গে দর-কষাকষি করে শেষ পর্যন্ত হেমায়েতপুরের মিতালী ট্যানারির কাছে সর্বোচ্চ ৮২০ টাকা পিস গরুর চামড়া বিক্রি করা হয়েছে, যা সরকারের বেঁধে দেওয়া দরের চেয়ে অনেক কম। গতবার এই চামড়া ৮৩০ টাকা পিস বিক্রি করা হয়েছিল। সরকার বেশি দামের কথা বললেও তা কার্যকর হয়নি। বিক্রেতারা ন্যায্য দাম পাননি। শুধু তাই নয়, ছাগলের চামড়া কিনতে অনীহা দেখিয়েছেন আড়তদাররা। একেকটি ছাগলের চামড়া বিক্রি হয়েছে সর্বোচ্চ ১০ টাকায়।’

পুরান ঢাকার লালবাগের পোস্তা কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের অন্যতম বড় জায়গা যাকে আড়ত বলা হয়। সেখানেও বড় ও মাঝারি আকারের গরুর চামড়া সর্বোচ্চ ৮০০-৯০০ টাকা পিস বিক্রি হয়েছে। কম দামে চামড়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের (বিএইচএসএমএ) সভাপতি আফতাব খান বলেন, ‘ট্যানারি মালিক অর্থাৎ ক্রেতাদের কাছে সরকার ১২০০ টাকা লবণযুক্ত চামড়া বিক্রির কথা বলেছে। আমরাও সেভাবে পাব আশা করি। তবে বিক্রেতাদের কাছে আমরা ৪৫০-৭০০ টাকা পিস বেশি চামড়া কিনেছি। ৭০০-৯০০ টাকা পিসও কিনেছি। বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে এবং হেমায়েতপুরেও আড়তদাররা চামড়া কিনছেন। তাই পোস্তায় আড়ত ৬৭টি থেকে ৪১টিতে নেমেছে। পোস্তায় এ মৌসুমে ১ লাখ কাঁচা চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়েছে। ঠিকভাবে সংরক্ষণ না করায় প্রতিবছর অন্তত ১৫ থেকে ২০ শতাংশ কোরবানির চামড়া নষ্ট হয়। এবারও প্রচণ্ড গরমে চামড়া নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’

এতো কম দাম কেন? এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. শাহিন আহমেদ বলেন, ‘ঈদের দিন ৮ লাখ পিস চামড়া কেনা হয়েছে। ১ হাজার টাকা পর্যন্ত কেনা হয়েছে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘৮২০ টাকা পিস কম না। এটা অনেক বেশি দাম বলা যায়। কারণ এর সঙ্গে লবণ, শ্রমিকের মজুরি ও পরিবহন খরচ যুক্ত হবে। তাতে সরকারের নির্ধারিত দামের কাছে চলে যাবে।’

বরিশাল জেলায় কোরবানি হওয়া গরুর চামড়া ফেলে দেওয়া কিংবা নষ্ট হওয়ার মতো ঘটনা না ঘটলেও ছাগলের চামড়া কেউ কেনেননি। বরিশাল হাইড অ্যান্ড স্কিন অ্যাসোসিয়েশন সভাপতি বাচ্চু মিয়া খবরের কাগজকে বলেন, ‘বেশির ভাগ ছাগল ও বকরি চামড়া বিক্রেতারা দোকানের সামনেই ফেলে রাখে। পরে সেগুলো আমাদের শ্রমিক দিয়ে কোরবানির দিন রাতে মাটি চাপা দিয়ে দিয়েছি।’

চট্টগ্রামের আতুরার ডিপোর আড়তে আড়াই লাখ এবং উপজেলায় দেড় লাখ চামড়া লবণজাত করা হয়েছে। তবে লবণজাত করতে সময়ক্ষেপণ হওয়ায় ৮ থেকে ১০ হাজার পিস নষ্ট হয়। ব্যবসায়ীরা জানান, চট্টগ্রাম নগরের আড়তদাররা আড়াই লাখ চামড়া সংরক্ষণ করেছেন। উপজেলা পর্যায়ে বিভিন্ন মাদ্রাসা ও প্রান্তিক ব্যবসায়ীরা প্রায় দেড় লাখ কাঁচা চামড়া লবণজাত করে সংরক্ষণ করেছেন। আড়তে ব্যবসায়ীরা ২০০ থেকে ৬০০ টাকার মধ্যেই কিনছেন কাঁচা চামড়া। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা তেমন লাভ করতে পারেননি চামড়া ব্যবসা করে। নগরের আগ্রাবাদ ও সুন্নিয়া মাদ্রাসা এলাকায় কিছু চামড়া নষ্ট হয়েছে বলে জানা গেছে।

খুলনায় এবার কোরবানির ঈদে চামড়ার বাজার সিন্ডিকেটের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। মূল ব্যবসায়ীরা কেউ চামড়া কিনতে আগ্রহী না হওয়ায় অনেকেই গরু-ছাগলের চামড়া আশপাশের মসজিদ মাদ্রাসায় দিয়ে দিয়েছেন। মসজিদ ও মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ এই চামড়া নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। তারা প্রতিটি গরুর চামড়া ৫০০-৬০০ টাকা দরে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেছেন। ছাগলের চামড়া বিক্রি হয়েছে ৫০-১০০ টাকায়।

খুলনা জেলা কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. আব্দুস সালাম ঢালী জানান. এবার ঈদে প্রায় ৫০ হাজার গরু ও ৩০ হাজার ছাগলের চামড়া কেনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু মূল ব্যবসায়ীরা তা সংগ্রহ করতে পারেননি। যে যার মতো সড়কের ওপর দাঁড়িয়ে বিক্ষিপ্তভাবে চামড়া কিনেছেন। এখন তা-ও বিক্রি হচ্ছে না। ট্যানারি মালিকদের কাছে খুলনার ব্যবসায়ীদের কোটি কোটি টাকা বকেয়া পাওনা থাকায় এই ব্যবসায় মন্দা যাচ্ছে। ট্যানারি মালিকরা বকেয়া পরিশোধের ভয়ে চামড়া কিনছেন না। আবার স্থানীয় অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটে চামড়া তুলনামূলক কম দামে বাইরে পাচার হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে প্রতি বর্গফুট চামড়া ৫০-৫৫ টাকা নির্ধারণ করা হলেও কোথাও সেই দামে বিক্রি হয়নি। ১ থেকে ২ লাখ টাকায় গরু কিনেও চামড়া ২০০-৫০০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে।

বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় চামড়ার হাট শহরতলির শম্ভুগঞ্জে। কোরবানির পর এ হাটে বিভাগের ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা জেলা ছাড়াও সুনামগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জ জেলার কিছু এলাকা থেকেও চামড়া নিয়ে আসেন ব্যবসায়ীরা। গত বছর সিন্ডিকেটের কারণে কম দাম পেয়ে হতাশ হন ব্যবসায়ীরা। এবারও এখন পর্যন্ত আশানুরূপ চামড়া বিক্রি হয়নি।

এবার লোকসান হলে চামড়ার ব্যবসা ছেড়ে দিবেন জানিয়ে মজিন্দ্র মনি ঋষি বলেন, ‘অন্তত ৪৫ বছর ধরে চামড়ার ব্যবসা করছি। কয়েক বছর ধরে লোকসান গুনছি। এবার কয়েকজন ট্যানারি মালিকদের প্রতিনিধি চামড়া কিনতে যোগাযোগ করেছেন। তবে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে কম বলেছেন। ন্যায্য দাম পাওয়ার আশায় এখনো বিক্রি করিনি। এবার চামড়া ব্যবসায় লাভ করতে না পারলে এ ব্যবসা ছেড়ে দেব।’

রাজশাহীতে এবার ৩ লাখ ৫৬ হাজার ৭৯০টি পশু কোরবানি হয়েছে। তবে বেশির ভাগ চামড়াই চলে গেছে নাটোরের আড়তে। রাজশাহীতেও সংগ্রহ করা হয়েছে। এবার জেলায় কোন পশুর চামড়া ফেলে দেওয়া বা বিক্রি হয়নি এমন ঘটনা ঘটেনি। রাজশাহী জেলা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতর সভাপতি মো. আসাদুজ্জামান বলেন, আমরা সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে এবার সব চামড়া কেনার চেষ্টা করছি। এবার রাজশাহী জেলাতে গরুর চামড়া কেনা হয়েছে ৬০ হাজার।

গত কয়েক বছর ধরে রংপুরে চামড়া সস্তায় বিক্রি হচ্ছে। কোনো খুচরা ব্যবসায়ী সরকার নির্ধারিত মূল্যে চামড়ার দাম পাননি। মাঝখান থেকে লাভবান হয়েছে মধ্যসত্ত্বভোগীরা ও বড় বড় ব্যবসায়ীরা। এবারে চামড়ার ভালো দাম না পাওয়ার কারণ জানতে কথা হয় প্রবীণ আড়ত মালিক এনামুল হকের সাথে। তিনি জানান, ট্যানারি মালিকদের কাছে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের লাখ লাখ টাকা বকেয়া পড়ে রয়েছে। ব্যবসায়ীদের অনেকে পুঁজি হারিয়ে পথে বসে গেছে। তিনি আরো বলেন, চামড়ার শিল্পে অতি দ্রুত ব্যাংক ঋণ ব্যবস্থা চালু করাসহ সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত জরুরি।

সিলেট লেদার অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি শাহিন আহমদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা এবার সারা জেলায় প্রায় ১ লাখ চামড়া সংগ্রহ করেছি। কিন্তু যেখানে চামড়া সংরক্ষণ করে রেখেছি সেখানেও পানি উঠে গেছে। তাই আমরা অনেক চামড়াই ঢাকায় বিক্রি করতে পারবো না। আবার এই নষ্ট চামড়াগুলো ফেলতেও আমাদের অনেক খরচ হয়ে যাবে। তাই এবার চামড়া সংগ্রহ করে আমাদের লোকসান হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। ছাগলের চামড়া আমরা বেশি কিনতে চাই না। কারণে একটা আমরা কিনে সংগ্রহ পর্যন্ত আমাদের প্রায় ৩০ টাকা খরচ হয়। কিন্তু ঢাকায় বিক্রি করতে হয় ৪০ টাকা করে। তাই লাভ হয় না। তাছাড়া ছাগলের চামড়া বেশিরভাগ সময়ই বেশি কাটা ছেড়া থাকে। তাই দাম পাওয়া যায় না বলে ব্যবসায়ীরা কিনেন না।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *