চট্টগ্রামরাজনীতি

প্রধানমন্ত্রীর ‘ছায়াকর্মী’ মুক্তিযোদ্ধা ইউনুছ

শ দুয়েক ‘বঙ্গবন্ধুভক্ত’ নিয়ে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি ‘কৃতজ্ঞতা’ জানিয়ে এলেন চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) নবনিযুক্ত চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ ইউনুছ। বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে আনুষ্ঠানিকভাবে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানানো প্রথম সিডিএ চেয়ারম্যান তিনি।

বঙ্গবন্ধুর ডাকেই ইউনুছ অস্ত্র হাতে জীবনবাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধে। বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসতেন প্রাণের চেয়েও বেশি। তাইতো হায়েনাদের হাতে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শহীদ হওয়ার খবরে বিচলিত হয়ে পড়েন। ওই সময় ছিলেন ঢাকায়। মর্মান্তিক খবরটি পেয়ে জন্মস্থান চট্টগ্রামে ফিরলেও নিজঘরে ফিরে যাননি। হাতে তুলে নেন অস্ত্র। প্রতিবাদ করলেন বঙ্গবন্ধু হত্যার। গ্রেপ্তার হয়ে কারাভোগ করেন কয়েক বছর। পরে ছুটে যান দিল্লি অবস্থানরত বঙ্গবন্ধুকন্যার কাছে। সেই থেকে শেখ হাসিনার ‘ছায়া’ হয়ে আছেন ইউনুছ।

বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগ টানা ক্ষমতায় দীর্ঘ বছর। ‘নির্লোভ’ ইউনুছ নিজের জন্য কিছু চাইতে যাননি কখনো! কিন্তু বঙ্গবন্ধুকন্যা ঠিকই খুঁজে নিয়েছেন দল ও দেশের জন্য ত্যাগী মানুষদের। এরই ধারাবাহিকতায় সত্তর বছর ছুঁই ছুঁই ইউনুছ পেলেন চট্টগ্রামের উন্নয়নের দায়িত্ব; সিডিএর চেয়ারম্যানের পদ। জীবনসায়াহ্নে এসে এমন গুরু দায়িত্ব পেয়ে নেমে পড়লেন কাজে। দায়িত্ব নিয়েই দোয়া চাইতে ‘কৃতজ্ঞতা’ জানাতে ছুটে গেলেন বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধে। আর বেছে নিলেন এমন একটা দিন; বঙ্গবন্ধুকন্যার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিন।

দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথমবারের মতো ১৭ মে বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে যান সিডিএ চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইউনুছ। দুই শতাধিক মানুষের বহর নিয়ে আগের রাতে চট্টগ্রাম থেকে টুঙ্গিপাড়ার উদ্দেশ্যে রওনা হন তিনি। তাঁর সফরসঙ্গী ছিলেন চট্টগ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ পরিবারের সদস্য, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান, সিডিএ কর্মকর্তা, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মী এবং সাংবাদিক ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা। দিনভর সমাধিসৌধে ছিল খতমে কোরআন, দোয়া, মিলাদ, পুষ্পার্ঘ অর্পন, আলোচনাসহ নানা আয়োজন।

কর্মসূচির এক ফাঁকে নিউজ পোর্টাল সিভয়েস২৪সহ কয়েকটি গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। সঙ্গে ছিলেন বাংলাদেশ প্রতিদিনের বিশেষ প্রতিনিধি ও চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি রিয়াজ হায়দার চৌধুরী এবং বিএফইউজে-বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের যুগ্ম মহাসচিব মহসিন কাজী প্রমুখ।

সাক্ষাৎকারে সিডিএ চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইউনুছ বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকন্যার ছায়াসঙ্গী আমি। প্রধানমন্ত্রী তাঁর কাঁধেই তুলে নিয়েছেন চট্টগ্রামের উন্নয়নের দায়িত্ব। আমি তাঁর ছায়া হিসেবে মাঠে ছিলাম, আছি। ভবিষ্যতেও থাকব। পরিকল্পিত পরিবেশবান্ধব চট্টগ্রাম গড়তে কাজ করে যাব আমৃত্যু।’

বীর মুক্তিযোদ্ধা ইউনূছ বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে যেদিন হত্যা করা হয়, সেদিন আমরা কয়েকজন ঢাকায় ছিলাম। পরে চট্টগ্রামে ফিরলেও আমরা কেউ আর নিজঘরে ফিরিনি। আমরা হাতে অস্ত্রধারণ করি। জনযুদ্ধ, গেরিলাযুদ্ধ করতে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের কাছ থেকে কিছু সাহায্য নিতে হয়।—এটাই নিয়ম। কিন্তু আমরা যা আশা করেছিলাম; তখন ভারতের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের কারণে সেখানেও ব্যর্থ হই। এরপর আমরা হাতে তৈরি বোমা দিয়ে ঘাতকদের প্রতিরোধের চেষ্টা করি। এমনকি চট্টগ্রামে আমরাই প্রথম জাতীয় মুজিব বাহিনী গঠন করি মহিউদ্দিন ভাই (সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী ও মৌলভী সৈয়দ (বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়ে প্রথম শহীদ। তাঁর বাড়ি বাঁশখালীর শেখেরখীলে।) ভাইয়ের নেতৃত্বে। পরবর্তীতে সামরিক জান্তা ষড়যন্ত্রমূলক মামলা দেওয়া শুরু করে সবার বিরুদ্ধে। একপর্যায়ে আমরা গ্রেপ্তার হই। চার বছর কারাগারে ছিলাম।’

বঙ্গবন্ধুকে ঘাতকের হাত থেকে রক্ষা করতে না পারার দুঃখ সারাক্ষণ পীড়া দেয় জানিয়ে সিডিএ চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইউনুছ বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর মতো বিশ্বে আর কোনো নেতা নেই; যার নির্দেশে হাসতে হাসতে প্রাণ বিসর্জন দিয়ে নিজেদের মানচিত্র ছিনিয়ে আনবে কর্মীরা। বঙ্গবন্ধু আমাদের অস্তিত্ব। বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু বাংলার ভাষা। বঙ্গবন্ধু বাংলার প্রকৃতি-সবুজ আঙিনা। বঙ্গবন্ধু লাল-সবুজের পতাকা। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ৩০ লাখ মানুষ প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন এ বাংলাদেশের জন্য। আজকে বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশের অবস্থান সৃষ্টি করতে পেরেছি শুধু বঙ্গবন্ধুর জন্য। আর বিশ্বে বাঙালি বলে যে একটা জাতি আছে; তার অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছি বঙ্গবন্ধুর জন্ম হয়েছিল বলেই।‘

‘আজকে সেই বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে এসে কীভাবে ভাষায় প্রকাশ করবো যে; বড় দুঃখ হয় একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমি আমার বঙ্গবন্ধুকে ঘাতকের হাত থেকে রক্ষা করতে পারিনি। আজকে যদি ওনি থাকতেন আমরা কতোই প্রফুল্ল হতাম।’-যোগ করেন মুক্তিযোদ্ধা ইউনুছ।
বঙ্গবন্ধুকন্যার ছায়াকর্মী হিসেবে কাজ করেন উল্লেখ করে আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ ইউনুছ বলেন, ‘পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে অনেক বড় নেতাকে তাঁদের কর্মকাণ্ডে সামরিকজান্তার সেবাদাস মনে হতো ।’
‘‘বঙ্গবন্ধু হত্যার পর দিল্লিতে ছুটে গিয়েছিলাম বঙ্গবন্ধুকন্যার সঙ্গে দেখা করতে। আপাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘বাংলাদেশের কোন নেতার প্রতি আপনার আশীর্বাদ আছে? ওনি সরাসরি কোন নাম না নিয়ে বললেন, ‘তোরা কাজ কর। আমি তোদের সাথে আছি।’ তিনবার জিজ্ঞেস করলাম। তিনবারই একই কথা। সেই থেকে আমি বঙ্গবন্ধুকন্যার একজন ছায়াকর্মী। এখনো আছি, আমৃত্যু থাকবো। আমি ওনার ছায়া, আমি ছায়ার মতো ওনার কর্মী হিসেবে কাজ করতে ভালোবাসি।’’—বলেন ইউনুছ।
বঙ্গবন্ধুকন্যার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পরও নানা ষড়যন্ত্রের কথা উল্লেখ করে ইউনুছ বলেন, ‘দেশে আসার পরে বঙ্গবন্ধুকন্যাক ২৭ বার হত্যার চেষ্টা করা হয়। চট্টগ্রামে ২৪ জানুয়ারির যে ঘটনা সেখানেও আমি আপার সঙ্গে ছিলাম। শেখ হাসিনার চেহারার মাঝে আমি আমার বঙ্গবন্ধুকে খুঁজে পাই। আমি আমার বাংলাদেশকে খুঁজে পাই। ওনার জন্য আমি জীবন উৎসর্গ করতে কুণ্ঠাবোধ করবো না।’
চট্টগ্রামের সার্বিক উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রসঙ্গে সিডিএর নতুন চেয়ারম্যান বলেন, ‘চট্টগ্রামের উন্নয়নের দায়িত্বটা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছেন। চট্টগ্রামের জন্য নানা প্রকল্পে উল্লেখযোগ্য অনুদান দিয়েছেন। আমার প্রথম এজেন্ডা হচ্ছে ওই কাজগুলোকে সুন্দরভাবে শেষ করা। যে আশা নিয়ে দায়িত্বটা ওনি কাঁধে নিয়েছেন; সেই কাজ যথাসময়ে শেষ করে ওনার মুখটা উজ্জ্বল করা। চট্টগ্রামে আগামী ৫০ বছর পর, জনসংখ্যা বাড়ার পর পরিস্থিতি কী হতে পারে; সেটাকে লক্ষ্য রেখে পরিবেশবান্ধব একটি বন্দরনগরী গড়ে তোলাই আমার লক্ষ্য।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *