চট্টগ্রামসাতকানিয়া

নদভীর ‘শাগরেদ’ এখন মোতালেবে মাতোয়ারা

আরও বছর সাতেক আগের কথা। তিনি ছিলেন স্বাচিপ (স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ) নেতা ডা. মিনহাজুর রহমানের একনিষ্ঠ কর্মী। তাঁর হাত ধরেই সাবেক এমপি ড. আবু রেজা নেজামুদ্দীন নদভী বলয়ে ‘ইন’ করেন। ধীরে ধীরে নদভীকে বশ করে ‘কব্জায়’ নেন উপজেলা ছাত্রলীগের শীর্ষ পদ। ‘কৃতজ্ঞতা’ স্বরূপ তোপের মুখে পড়বেন জেনেও শোক জানিয়েছিলেন নদভীর শ্বশুর জামায়াত নেতা মমিনুল হক চৌধুরীর মৃত্যুতেও। তাও ছাত্রলীগের ব্যানারে। তবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নদভীর ভরাডুবির পর ভোল পাল্টে ফেলেছেন তিনি। ‘খোলস বদলে’ রাতারাতি তিনি বনে গেছেন বর্তমান সংসদ সদস্য এম এ মোতালেব বলয়ের ‘খাঁটি ভক্ত’। শুধু তাই নয়, একসময়ের রাজনৈতিক ‘অভিভাবক’ নদভীর বিরুদ্ধে মোতালেবে মাতোয়ারা দলে সামিল হয়েছেন তিনিও!

ক্ষমতার মোড় বদলে এমন রাজনৈতিক ভেলকি দেখিয়েছেন যিনি তাঁর নাম আবদুল মান্নান। তিনি সাতকানিয়া উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। তাঁর এমন ভেলকিবাজিতে ‘বিচলিত’ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাও। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কেউ প্রকাশ্যে, কেউ ছলেবলে, কেউ সরাসরি তীর্যক মন্তব্য করছেন। কেউ কেউ সাধুবাদও জানিয়েছেন তাঁকে। তবে বেশিরভাগ মন্তব্য নদভীকে ছেড়ে নতুন বলয়ে যোগ দেওয়া নিয়ে। সবশেষ তাঁর ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডি ঘুরে দেখা গেছে, গত বছরের ২১ ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি নদভীতে ‘মাতোয়ারা’ ছিলেন। এরপর ধীরে ধীরে মোতালেব বলয়ে ঘেঁষেন তিনি।

আলাউদ্দিন রনি নামে একজন ফেসবুকে তাঁর পোস্টে লিখেছেন, ‘আরো অনেক কিছু দেখার বাকি আছে।’ উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী তুহিন খুঁনসুটি করে আরেকটি পোস্টে লিখেছেন, ‘আমাদের সাবেক এমপি মহোদয় প্রফেসর ডঃ আবু রেজা নদভী ভাইয়ের জন্য একটু মন খুলে দোয়া করিয়েন।’ সেখানেও পক্ষে বিপক্ষে অনেক মন্তব্য এসেছে। মোহসিন নামে আরেকজন লিখেছেন, ‘আল্লাহ সবাইকে বুঝার তৌফিক দান করুক’।

তবে এসব বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মান্নান। তিনি বলেন, ‘আমরা রাজনীতি করছি, ছাত্রলীগের দায়িত্বে আছি, সংগঠন করছি। আমরা অন্যায় কিছু করছি না।’ তবে নদভীর শ্বশুর মমিনুল হক চৌধুরীর মৃত্যুতে শোক ব্যানার টাঙাননি বলেও দাবি করেছেন তিনি।

স্রোতে টিকতে মান্নানের ঝাঁপ, কমিটি দিতে আগলে নিলেন মোতালেবপন্থীরা

রাজনীতির স্রোতে টিকে থাকতে সাতকানিয়া উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মান্নান ‘পায়চারি’ করছিলেন। পদের কারণে তাঁকে ‘লুফে’ নিয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য এম এ মোতালেব বলয়ের নেতাকর্মীরা। দুই গ্রুপের একাধিক ছাত্রনেতার সঙ্গে কথা বলে এসব জানা গেছে।

সূত্র মতে, উপজেলা ছাত্রলীগের পদ থেকে পদত্যাগের চিন্তাভাবনা করেছিলেন ছাত্রলীগ নেতা মান্নান। তবে ‘ফন্দিফিকির’ আঁটছিলেন কীভাবে স্রোতে গা ভাসানো যায়। হঠাৎ কমিটি বাঁচানোর ‘টোটকা’ আসে মোতালেব বলয় থেকে। সুযোগ বুঝে ঝাঁপ দেন মোতালেব বলয়ে। বলয়ের নেতৃত্বে থাকা আওয়ামী লীগের একাধিক শীর্ষ নেতার ‘সমঝোতায়’ বরণ করে নেওয়া হয় সাবেক এমপি নদভীর ‘শাগরেদ’ মান্নানকে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুই বলয়ের ছাত্রলীগ নেতারা বলেন, ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে আবদুল মান্নান পদত্যাগ করলে পুরো কমিটি ‘অচল’ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হবে। কারণ কমিটিতে নতুন করে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব কাউকে কেন্দ্র নাও দিতে পারে। সেক্ষেত্রে নতুন কমিটির জন্য দৌঁড়ঝাঁপ কষ্টকর। তাই হাতের নাগালে পাওয়া টোটকা ব্যবহার করে ছাত্রলীগ নেতা মান্নানের পদে ভর করেছেন মোতালেবপন্থী নেতারা। এখন তাঁকে নিয়েই বিভিন্ন ইউনিয়ন কমিটি দিচ্ছেন।

এ বিষয়ে উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মোহাম্মদ আলীর মন্তব্য জানতে ফোন করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।

নদভীবিরোধী সম্মেলনেও যোগদান!

গত বৃহস্পতিবার সাবেক এমপি নদভী এক সংবাদ সম্মেলন করে বর্তমান সংসদ সদস্য এম এ মোতালেবের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করেছিলেন। ওই অভিযোগের জবাব দিতে রবিবার (২৪ মার্চ) এম এ মোতালেব পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করেন। নদভীবিরোধী সম্মেলনে মোতালেবে মাতোয়ারা দলে সাঙ্গ হয়েছিলেন মান্নানও।

এ নিয়ে চলছে নানান কথা। নুন খেয়ে গুন গাইলেন না তো গাইলেন না উল্টো যে পাতে খেলেন সে পাত ছিঁড়লেন!— মোতালেবে মাতোয়ারা দলে কোণঠাসা নদভীপন্থীরা ‘চুপেচাপে’ এ ধরনের মন্তব্য করলেও সরাসরি মুখ খুলতে নারাজ।

নদভী বন্দনায় এখনো মোতালেব গঞ্জনা

ভোটের সময়েও নদভী বন্দনায় ছিলেন ছাত্রলীগ নেতা আবদুল মান্নান। ভোটের প্রচার-প্রচারণা থেকে শুরু করে ‘স্বতন্ত্র প্রার্থী’ মোতালেব গঞ্জনায়ও ছিলেন। গত বছরের ৩০ নভেম্বর একটি পোস্ট করে তিনি লিখেছিলেন, ‘ব্রিকফিল্ড, বনফুলের কর্মচারী, সেই সাথে ১৪ আসনের ৬ ইউনিয়ন নিয়ে বনফুলের গণবিপ্লব!!! গণজাগরণ!!! পাগলের সুখ মনে মনে।’ সেখানে তাঁর অনুসারি নেতাকর্মীরা পোস্টের পক্ষে নানা মন্তব্য করেছেন।

নদভীর শ্বশুর জামায়াত নেতা মমিনুলের মৃত্যুতে টাঙানো হয়েছিল শোকব্যানার

২০১৯ সালে জামায়াতে ইসলামীর কর্ম পরিষদ সদস্য মুমিনুল হক চৌধুরীর মৃত্যুতে শোক জানিয়ে ব্যানার টানিয়েছেন সাতকানিয়া উপজেলা ছাত্রলীগ নেতা আব্দুল মান্নান। উপজেলার চরতী ইউনিয়নের তুলাতলি বাজার এলাকায় টানানো শোকের ওই ব্যানার টাঙানো হলে সেই সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠে। মমিনুল হক চৌধুরী চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া) থেকে নির্বাচিত সাবেক এমপি ড. আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামউদ্দিন নদভীর শ্বশুর।

ব্যানারে উল্লেখ করা হয়, ‘সাতকানিয়া-লোহাগাড়ার সংসদ সদস্য প্রফেসর ড. আবু রেজা মুহাম্মদ নেজাম উদ্দিন নদভী এমপি মহোদয়ের শ্বশুর ও রিজিয়া রেজা চৌধুরীর শ্রদ্ধেয় পিতা আলহাজ মাওলানা মুমিনুল হক চৌধুরীর মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে শোকাহত। আমরা মরহুমের রুহের আত্মার মাগফিরাত কামনা ও শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি।’ ব্যানারের নিচের অংশে লেখা হয় শোকার্তে -আব্দুল মান্নান, সভাপতি, সাতকানিয়া উপজেলা ছাত্রলীগ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *